শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০১:৫৯ অপরাহ্ন

নানা অব্যবস্থাপনায় শুরু গণটিকা ক্যাম্পেইন

নানা অব্যবস্থাপনায় শুরু গণটিকা ক্যাম্পেইন

স্বদেশ ডেস্ক:

গণটিকাদানের বিশেষ ক্যাম্পেইন শুরুর দিনে গতকাল শনিবার সারাদেশের কেন্দ্রগুলোতে চরম অব্যবস্থাপনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সময় কেন্দ্রে এসে টিকা না পেয়ে ফিরে গেছেন অনেকে। আবার জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে গেলেই টিকা মিলবে এমন ঘোষণা থাকলেও অনেক কেন্দ্রে আগে থেকেই নিবন্ধন করা হয়েছে। অভিযোগ মিলেছে টিকাগ্রহীতার নাম নিবন্ধনে স্বজনপ্রীতিসহ নানা অনিয়মেরও।

এ ছাড়া কেন্দ্রগুলোতে মানা হয়নি ন্যূনতম সামাজিক দূরত্ব। টিকা নিতে এসে মানুষ রীতিমতো গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল লাইনে। টিকা কেন্দ্রের ভেতরেও ছিল জনাকীর্ণ অবস্থা। গতকাল রাজধানী ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন কেন্দ্র সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। এ সময় টিকাদানের এমন অব্যবস্থাপনায় চরম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন টিকাগ্রহীতারা।

করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ছয় দিনে ৩২ লাখ মানুষকে টিকাদানের আওতায় আনতে গতকাল পরীক্ষামূলক এ কার্যক্রম শুরু হয়। এদিন তাই টিকা নিতে দেশজুড়ে কেন্দ্রগুলোতে ছিল মানুষের উপচেপড়া ভিড়। সরকার প্রথমে রেজিস্ট্রেশন করে টিকা দেওয়ার নিয়ম চালু করলেও এ বিশেষ ক্যাম্পেইনে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়েই মানুষ টিকা নিতে পেরেছে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, টিকা গ্রহীতাদের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি রাখা হচ্ছে, যেগুলো তারা নিজেরাই পরে মূল ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করে দেবেন। ফলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে টিকা গ্রহীতারা স্বাস্থ্য বিভাগের টিকা সম্পর্কিত এসএমএস পেয়ে যাবেন। কিন্তু এটি করতে গিয়েই ভিড়ের কারণে অনেক কেন্দ্রেই চরম অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি উপেক্ষিত হয় স্বাস্থ্যবিধি।

এদিন অব্যবস্থাপনা ও ভোগান্তি দেখা গেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৭নং ওয়ার্ডে। জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে কেন্দ্রে গিয়েও এদিন টিকা না পেয়ে অনেকে ফিরে যান। কেন্দ্র থেকে বলা হয়, নিবন্ধন করার পর তাদের টিকা দেওয়া হবে। টিকা কেন্দ্রের সুপারভাইজার শহিদুর রহমান জানান, আমাদের কেন্দ্রে প্রতিদিন ৩০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। যারা গত শুক্রবার নিবন্ধন করেছেন তারা আজ টিকা পাচ্ছেন। আজ যারা নিবন্ধন করবেন তারা কাল (রবিবার) টিকা গ্রহণ করবেন। ওয়ার্ডের কার্যালয়েই নিবন্ধন করে তাদের একটা কার্ড দেওয়া হচ্ছে। টিকা নিতে আসতে হলে এ কার্ড নিয়ে আসতে হবে। কাউন্সিলর অফিসের সিল এবং সিরিয়াল নম্বর (১ থেকে ৩০০) যারা পাবেন তাদের টোকেন দেওয়া হবে। এ টোকেন দেখিয়েই টিকা মিলবে।

প্রায় একই অবস্থা ছিল ৩৬নং ওয়ার্ডেও। ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে যে কেউ জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে এসে টিকা নিতে পেরেছেন এখানকার টিকাদান কেন্দ্র শের-ই-বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজে। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টিকা প্রত্যাশীদের ভিড়ও বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে দুপুরের আগেই শেষ হয়ে যায় কেন্দ্রের জন্য বরাদ্দের টিকা। এমন ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইনে দাঁড়ানো স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, টিকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে এত কম লোকের টিকা কেন এনেছে কর্তৃপক্ষ। অনেকে দিনের প্রয়োজনীয় কাজ বাদ দিয়ে টিকা নিতে এসেছেন। লাইনে দাঁড়িয়েছেন তিন-চার ঘণ্টা। কিন্তু টিকা নেওয়া ছাড়াই তাদের ফেরত যেতে হচ্ছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে টিকাদান কেন্দ্র ছিল লালবাগের হাজী আব্দুল গণি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে টিকা নিতে আসা শাহিনুর ইসলাম বলেন, জনগণ আসলে সচেতন নয়। যার কারণে এই হ-য-ব-র-ল অবস্থা। সবাই যদি ধীরে ধীরে সিরিয়াল মেনে টিকা নিত, তা হলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। তা ছাড়া একটি কেন্দ্রে একটি বুথ না করে একাধিক বুথ করলে ভালো হতো।

আমাদের রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজে এদিন সকাল সাতটা থেকেই টিকা নিতে আসা মানুষের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় আরও বেড়েছে। কিন্তু সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদই কেন্দ্রের জন্য নির্ধারিত টিকা শেষ হয়ে যাওয়ার ঘোষণা আসে। এতে কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ ধৈর্য হারিয়ে ফেলে টিকাদান কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে মারমুখী আচরণ শুরু করেন। একপর্যায়ে হুড়াহুড়ি আর ধাক্কাধাক্কিতে টিটিসি ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে বিশৃঙ্খলার কারণে স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকার সরঞ্জাম ফেলেই বুথ ফেলে সরে যান। শেষ পর্যন্ত বেশিরভাগ মানুষকেই টিকা না নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হয়। একইভাবে রাজশাহী বিভাগীয় পুলিশ লাইন্স হাসপাতাল কেন্দ্র, আইডি হাসপাতাল কেন্দ্র ও সিএমএইচ কেন্দ্রেও অতিরিক্ত ভিড় পরিলক্ষিত হয়। ফলে এসব কেন্দ্রেও ভিড়ে চরম ভোগান্তিতে পড়তে টিকাদান কর্মী ও গ্রহণকারীরা।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) বলছে, ভুল বুঝে মানুষ টিচার্স ট্রেনিং কলেজসহ পূর্বের চারটি টিকাদান কেন্দ্রে গণটিকা নিতে গিয়েছেন। যার কারণেই এমন বিপত্তি ঘটেছে। নিয়ম হচ্ছেÑ এ চারটি কেন্দ্রে টিকা কার্ডের নির্দিষ্ট তারিখ অনুযায়ী টিকা নিতে হবে। কিন্তু গণটিকার কথা শুনে কোনো তারিখ দেখার বালাই ছিল না। যারাই এ চারটি কেন্দ্রে আগে যারা রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন তাদের অধিকাংশই এদিন টিকা নিতে সেখানে ভিড় করেন। রাসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এফ এ এম আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন, কোনো কোনো ওয়ার্ডে দুটি, কোনো ওয়ার্ডে তিনটি পর্যন্ত কেন্দ্র করা হয়েছে। মানুষ না বুঝে নিবন্ধন করা কেন্দ্রে চলে গেছেন। দুপুর ১২টার দিকে আমি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। সেখানে পরিস্থিতি দেখে অতিরিক্ত আরও ১ হাজার ২০০ টিকা দিয়ে এসেছি। তার পর আবারও টিকা কার্যক্রম সেখানে চালু হয়।

গাজীপুর সদর প্রতিনিধি জানান, শ্রীপুরের আবদারবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টিকা দেওয়ার কথা ছিল সকাল ৯টা থেকে। সাধারণ লোকজন সঠিক সময়েই লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। কেন্দ্রটি উদ্বোধন করার কথা ছিল স্থানীয় এমপি ইকবাল হোসেন সবুজের। কিন্তু তিনি কেন্দ্রে আসেন সাড়ে ১০টায়। ফলে এর মধ্যেই টিকা প্রত্যাশীদের লাইন দীর্ঘ হয়ে যাওয়ায় হিমশিম খান সংশ্লিষ্টরা। এদিন টিকা দেওয়ার খবরে এ কেন্দ্রে উপস্থিত হয় হাজারো মানুষ। তবে শেষ পর্যন্ত সেখানে মাত্র ৬০০ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়। ফলে দুপুর ১টায় টিকা শেষ হয়ে যাওয়ায় বাড়ি ফিরে যান অনেকে। এ কেন্দ্রের স্বাস্থ্য সহকারী রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের কেন্দ্রে আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে ৬০০ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। অনেকেই নিজে নিবন্ধন করে এসেছেন। যারা নিবন্ধন ছাড়া এসেছেন তাদের আমরা নিবন্ধন করে দিয়েছি। এখানে ৩৪৮ জন পুরুষ ও ২৫২ জন নারী টিকা নিয়েছেন।

চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, বৃষ্টির মধ্যে সদর উপজেলার আশিকাটি ইউনিয়ন পরিষদ কেন্দ্রে এদিন টিকা নিতে গাদাগাদি করে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন প্রচুর মানুষ। সরকার এদিন টিকাদানে বয়স্ক, মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা ও প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল ভিন্ন। বয়স্ক, প্রতিবন্ধীদের পেছনে ফেলেই অনেক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষকে টিকা নিতে দেখা যায়। ফলে এ কেন্দ্রে অভিযোগ উঠেছে স্বজনপ্রীতির। এ ব্যাপারে ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার দুলাল মাল ও ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার লোকমান মুন্সী বলেন, দুটি ওয়ার্ডে প্রায় ৯ হাজার ভোটার রয়েছে। আমরা টিকা পেয়েছি মাত্র ৬০০। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেকে বাদ পড়েছেন। তবে পছন্দের ব্যক্তি প্রসঙ্গ টানলে তারা অস্বীকার করেন।

খুলনার নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করেও এদিন শহরের প্রতিটি কেন্দ্রে ছিল উপচেপড়া ভিড়। তবে অধিকাংশ কেন্দ্রে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা ছিল পদে পদে। ছিল না স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বালাই। নগরীর ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের সোহরাওয়ার্দী কলেজ কেন্দ্র, লায়ন্স স্কুল কেন্দ্র ও ২৬নং ওয়ার্ডের ঈদগাঁ স্কুল কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, টিকা প্রত্যাশীরা ভিড় করে আছেন। এ সময় সিরিয়ালের তালিকায় আগেই নাম লিখে রাখা, সিরিয়াল অনুসরণ না করা, দল আর স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাসেবকদের অজ্ঞতা, টিকা প্রদানকারীদের অদক্ষতা ইত্যাদি অভিযোগ ছিল টিকা না পেয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া মানুষের। প্রতিবন্ধী ও পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষদের টিকা দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও অনেক কেন্দ্রে তা অনুসরণ করা হয়নি। এ বিষয়ে খুলনা সিটি করপোরেশনের মেডিকেল অফিসার স্বপন হালদার জানান, দুপুর ১২টার আগেই সব কেন্দ্রের টিকা ফুরিয়ে গেছে। তবে নগর ভবনে টিকা প্রত্যাশীদের বিশৃঙ্খলা সম্পর্কে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। আজ রবিবার টিকাদান অব্যাহত থাকবে কিনা তিনি সে ব্যাপারেও তিনি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি। মুধু জানিয়েছেন, নগর স্বাস্থ্য ভবনে ৪৫ হাজার ২০০ ডোজ মডার্নার টিকা মজুদ আছে।

ফেনী প্রতিনিধি জানান, সেখানেও বিভিন্ন কেন্দ্রে সকাল থেকে টিকা নিতে মানুষের উপচেপড়া ভিড় ছিল। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনা ও টিকা শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে অনেককেই ফিরে যেতে হয়েছে। ফেনীর সিভিল সার্জন রফিক উস সালেহীন বলেন, প্রায় সাড়ে ৩১ হাজার টিকা দেওয়া হয়েছে। টিকার ডোজ কম থাকায় চাহিদা অনুপাতে দিতে পারিনি। পর্যায়ক্রমে টিকা আসবে। তখন সব মানুষকে টিকার আওতায় আনা যাবে।

ভোলার দৌলতখান প্রতিনিধি জানান, উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভাসহ ১০টি কেন্দ্রে ৬০০ জন করে মোট ৬ হাজার জনকে এদিন টিকা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রগুলোতে এদিন পুরুষের চেয়ে নারীদের উপস্থিতি ছিল বেশি। যদিও টিকা না থাকায় তাদের অনেককেই ফিরে যেতে হয়েছে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত ৭ ফেব্রুয়ারি টিকাদান কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত এক কোটি ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন। দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন হয়েছে ৪০ লাখেরও বেশি মানুষের। বর্তমানে বাংলাদেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্না, ফাইজার ও সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হচ্ছে। তবে আমদানিকৃত টিকার পরিমাণ চাহিদার তুলনায় অনেক কম।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877